মিয়ানমারের মর্টারশেলে দুজন নিহত, এক কন্যাশিশু আহত!

আবদুল্লাহ আল আজিজ,  কক্সবাজার জার্নাল ডটকম :

  • গুলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপ অব্যাহত

  • সীমান্তে থমথমে অবস্থা

  • শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা

  • প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসলো ১০৬ জন বিজিপি সদস্য

মিয়ানমারে চলমান সংঘাতে গোলাগুলি যেন থামছে না। কি স্থল কি আকাশপথ সমানতালে চলছে গোলাগুলি। হেলিকপ্টার থেকে করা হচ্ছে গুলি আবার হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে করা হচ্ছে গুলি। একই সঙ্গে মর্টার শেলের বিকট শব্দে কাঁপছে তুমব্রু, ঘুমধুম সীমান্ত।

এ পরিস্থিতিতে সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুর আড়াই টার দিকে মিয়ানমার থেকে ছোঁড়া একটি মর্টার সেল ঘুমধুম সীমান্তের জলপাইতলি এলাকায় এসে পড়েছে। এতে এক নারী সহ ২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও আরও এক শিশু। এঘটনার পরপরই চরম আতংকে রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা।

নিহতরা হলেন ওই এলাকার বাদশা মিয়ার স্ত্রী হোসনে আরা (৫৫) ও তাঁদের বাড়িতে ধানখেতে কাজ করা রোহিঙ্গা শ্রমিক নবী হোসেন ((৬৫) এবং আহত হয় হোসনে আরার ছয় বছর বয়সী নাতনি নুশরাত মনি। সে উখিয়ার এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মর্টার শেলে নিহতের ঘটনার পর স্থানীয় গ্রামবাসী আতঙ্কে গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন।

নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল মান্নান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি জানান, মিয়ানমার থেকে মর্টারশেল এসে দুজন নিহত হয়েছে। নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে, তুমব্রু সড়কসহ আশপাশের সড়কগুলোতে যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। থমথমে পরিস্থিতির মধ্যে সীমান্ত এলাকায় ছয়টি শিক্ষা প্রতিষ্টান বন্ধ করে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কেউ বাড়ি থেকেও বের হচ্ছেন না। প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ এলাকার ছেড়ে বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে চলে গেছে। সীমান্ত এলাকার কয়েকটি বাজারে দোকানপাট প্রায় বন্ধ দেখা গেছে। এরমধ্যেও যারা বাজারে আসছেন তারাও দ্রুত বাড়ি ফিরছেন।

নিহত হোসনে আরার পাশের বাড়ির বাসিন্দা মোহাম্মদ শাহজাহান (৫০) বলেন, তাঁর পরিবারের চার সদস্য নিয়ে উখিয়া সদরের আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। এই মর্টার শেল তাঁর বাড়িতেও পড়তে পারত। ভয়ে বউ-বাচ্চা কেউ থাকতে চাইছে না।

বেতবুনিয়া সড়কে বিকেল চারটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত অবস্থান করে দেখা যায়, এক ঘণ্টায় জলপাইতলী গ্রামসহ আশপাশের আরও দুটি গ্রামের অন্তত ৫০টি পরিবার প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় নিয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইকে অন্যত্র যাচ্ছেন।

জলপাইতলী গ্রামের ছালেহা বেগম (৪০) বলেন, মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহত হওয়ার পর বাচ্চাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা কোনোভাবে ঘরে থাকতে চাইছে না। এ কারণে তাদের নিয়ে বালুখালী এলাকায় বোনের বাড়ি যাচ্ছেন।

বেতবুনিয়া বাজারের ব্যবসায়ী শামশুল আলম বলেন, মিয়ানমার থেকে কিছুক্ষণ পর পর মর্টার শেল ও গুলি এসে পড়ছে বাড়িঘরে। এ জন্য দোকান বন্ধ করে দিয়ে পরিবার নিয়ে কুতুপালং বাজারে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, মর্টারশেলের আঘাতে দুজন নিহত হওয়ার পর এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। স্থানীয় লোকজন ভয়ে এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে । আবার কেউ কেউ এলাকায় আছেনও। লোকজন কৃষি কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন।

কক্সবাজার র‍্যাব ১৫ উপ-অধিনায়ক আবু সালাম চৌধুরী বলেন, বিগত কয়েকদিন ধরে সীমান্তেবর্তী এলাকার উত্তেজনা শুরু হয়েছে সেটি এখনো চলমান রয়েছে। সেক্ষেত্রে বর্ডার গার্ড বিজিবি,র‍্যাব,পুলিশ যে যার ক্ষেত্র থেকে দ্বায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। আর সীমান্তে ঘেঁষে যেসব পরিবার আছে তারা আতঙ্কে ঘর ছেড়ে অন্যত্র স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। এবং সবাইকে ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে না থেকে নিরাপদের থাকার অনুরোধ জানান। পাশপাশি সীমান্তের জোরদার করার জন্য,বিজিবি,র‍্যাব পুলিশ নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলো আরো জোড়দার করার চেষ্টার করে যাচ্ছি।

একইভাবে গতকাল রবিবার মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলিতে এপারে বাংলাদেশে প্রদীর চন্দ্র ধরসহ দুইব্যক্তি আহত হয়েছে। ঘটনাটি সীমান্তবর্তী রক্ষাকারী মিয়ানমার বাহিনী বিজিপির ১৯ জন প্রাণ রক্ষার্থের ভয়ে বাংলাদেশে অভ্যন্তরে প্রবেশ আশ্রয় নেয়। আজ সকাল পর্যন্ত মায়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষের জেরে এখন পর্যন্ত মায়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) এর ৯৫ জন সদস্য ও সন্ধায় সাতটায় আবারও ঢেকিবনিয়া ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসছে মিয়ানমার বিজিপির ১১ সৈনিক। মিয়ানমারের থাকে পালিয়ে আসা এই পর্যন্ত বিজিপির সংখ্যা দাড়ালো ১০৬ জনে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তাদেরকে নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয় রেখে খাবার দিচ্ছে প্রশাসন।

এদিকে সীমান্তের উত্তেজনার কারণে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিবেচনায় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম সীমান্তে থাকা প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে ৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে শিক্ষা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়র।

সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সন্ধায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আক্তারুন্নাহার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।

সীমান্তবর্তী বিদ্যালয় হল- বাইশ ফাঁড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,ভাজা বনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিমকুল তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দক্ষিণ ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

এবিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান জানিয়েছেন, সীমান্তের পরিস্থিতি উত্তেজনা বিরাজ করছে। যার ফলে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র স্থানে আশ্রয় নিয়েছে শিক্ষার্থীরসহ পরিবার পরিজনেরা। তাই স্বাভাবিক পরিস্থিতি অবনতির না হওয়ার পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। সেই সাথে সীমান্তবর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সার্বক্ষনিক মনিটরিং করা হচ্ছে।

সীমান্ত পরিদর্শনে গিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুরশেদ আলম সাংবাদিকদের জানান, বিদ্রোহী গোষ্ঠিকে যখন সীমান্তবর্তী মিয়ানমার বিজিপির যুদ্ধে পেরে উঠতে পারছিল নাহ তখন তারা জীবন বাচানোর জন্য বাংলাদেশে অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে চাই। সেসব বিষয়ে ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাক জানিয়ে মিয়ানমারের বিজিপির বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। তাদের মধ্যে যে কয়েকজন আহত রয়েছে তাদেরকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আদেশনুযায়ী খাবার দেওয়া হচ্ছে।

কক্সবাজার-৩৪ বিজিবির ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোরশেদ আলম বলেন, মিয়ানমারের ছোড়া মর্টারশেল বিস্ফোরণে দুইজন নিহত হয়েছে সেটি খুবই দুঃখের বিষয়। এবিষয়ে মিয়ানমারের সরকার কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের ডিপারটেশন ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে। সেই সাথে বাংলাদেশে কোন রোহিঙ্গা বা বিছিন্নতাবাদী দল যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেদিকে বর্ডার গার্ড বিজিবি কাজ করে যাচ্ছে।